এনায়েত মোল্লার চা

#এনায়েত_মোল্লার_চা

চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই এনায়েত মোল্লার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। চা দিয়েই তিনি শব্দ করে কুলি করলেন। তারপর বেলকনি দিয়ে সেই কুলি ফেলে বললেন, “আমাকে সবজি চা দিয়েছো কেন?”
তার স্ত্রী শায়লা অবাক হয়ে বললেন, “সবজি চা আবার কী? লেবু চা দিয়েছি।”
“কতবার বলেছি আদা, রসুন, লেবু, কমলার চা আমি খাই না। চায়ে থাকবে চাপাতি, চিনি এবং দুধ। অন্য কোন কিছু দিয়ে চা হয় না। সবজি খাবে মানুষ ভাতের সাথে। চা দিয়ে না।”
“চেঁচাচ্ছো কেন? একদিন খেলে কী হয়?”
“চেঁচানোর কাজ করেছো তাই চেচাচ্ছি। আর একদিন খেলে কী হয়-এটা কেন বললে? তোমাকে যদি এক দিনের জন্য বিষ খেতে দেয়া হয়, তুমি খাবে?”
শায়লা হতভম্ব দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো। এনায়েত মোল্লা কিছুটা দম নিয়ে বলল, “আজ সকালে কমলার জ্যুসের মধ্যে আঙুরের খোসা পেলাম। এর কারণ কী?”
“কমলা আর আঙুরের মিক্স জ্যুস করেছি তাই। তাতে সমস্যা কী হয়েছে?”
“মিক্স করেছো কেন? কমলা আর আঙ্গুরের স্বাদ আলাদা। আমার জিভ তো দুইটা না যে দুই জিব দিয়ে দুই রকম স্বাদ নেবো। আমার জিব একটা।”
শায়লা চুপ করে রইলো। এখন কথা বাড়ানোর কোন মানে হয় না। এমনিতেই এনায়েত মোল্লার টেপ রেকর্ডার চালু হয়ে গেছে। কথা বলে সেটির ভলিউম বাড়ানোর ইচ্ছা নেই শায়লার।
এনায়েত মোল্লা বেলকনি দিয়ে চা ফেলে দিলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, “যাও। চা নিয়ে এসো। আমার সামনে আর কোন দিন ভেজিটেবল স্যুপ আনবে না। চা চাইলে চা’ই আনবে।”
“এখন চা হবে না। চা পাতি শেষ।” বলেই ভেতরে চলে গেল শায়লা। এনায়েত মোল্লার বিরক্তি ভাবটা দ্বিগুণ হয়ে গেল। লেবু চা মুখে দিয়ে মুখটাই কেমন তেতো হয়ে গেছে। তিনি পত্রিকা পড়ছিলেন। মনোযোগ দিয়ে একটা নিউজ পড়ছিলেন বলে না দেখেই চুমুক দিয়েছিলেন কাপে। দেখলে তিনি কখনোই ঐ জিনিসে ঠোঁট ছোঁয়াতেন না। সকালটাই শুরু হবে চা ছাড়া ভাবতেই খারাপ লাগছে। কাজের ছেলেটাও ছুটিতে। চাপাতা কিনতে হলে তাকেই যেতে হবে। তিনি বিরক্তি মুখে উঠে দাঁড়ালেন। গায়ে পাঞ্জাবি জড়িয়ে রওনা দিলেন দোকানের দিকে। পেছন থেকে শায়লা বলল, “ভালো চাপাতি আনবে। দেখেশুনে সবচেয়ে বাজেটা কেনাই তো তোমার অভ্যাস।”

বাসার নিচের দোকানটা বন্ধ। এই দোকানটা কখনো বন্ধ হয় না। রাত দুইটার দিকেও খোলা থাকে। অথচ আজ সকাল বেলাই বন্ধ করে রেখেছে। এনায়েত মোল্লার রাগ আরও বেড়ে গেল। রাগ কমানোর জন্য তিনি দোকানের বন্ধ শাটারে জোরে একটা লাথি দিলেন। লাথি দেয়াতে একসাথে দুটো ঘটনা ঘটল। প্রথমত জুতোর ফিতা ছিড়ে গেল। ছেড়া জুতা হাতে নিতে গিয়ে দেখলেন তার পা থেকে রক্ত ঝরছে। বুড়ো আঙুল ফেটে গেছে। এনায়েত মোল্লা মনে করার চেষ্টা করলেন আজ ঘুম থেকে উঠে তিনি কার মুখ দেখেছেন। দিনটা এভাবে শুরু হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। তিনি হতাশ হয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। ঠিক সেই মুহুর্তে একটা কাক উপর থেকে সাদা রঙ ছুড়ে দিল। সেই রঙে রঙিন হয়ে তিনি খুব কুৎসিত একটা গালি দিলেন।
তিনি প্রথমে গেলেন ডিসপেনসারিতে। পায়ে একটা ব্যান্ডেজ লাগাতে হবে। সেখানে অল্প বয়সী একটা ছেলে বসে আছে। এনায়েত মোল্লা বললেন, “একটা ওয়ান টাইম…..” তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। ‘ব্যান্ডেজ’ নামটা তিনি ভুলে গেছেন। কথাটা তার পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না। তিনি অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। ছেলেটার বয়স কম। “হাত-পা কেটে গেলে কী জানি লাগাতে হয়?”- এই জাতীয় প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল না। তিনি বললেন, “দোকানে তুমি একাই? মুরুব্বি কেউ নাই?”
ছেলেটা বলল, “সমস্যা নাই। আমারে কন কী লাগবো?”
এনায়েত মোল্লা অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলেন। আঙুল থেকে এখন আর রক্ত ঝরছে না। ব্যান্ডেজ না হলেও হয়। এমন সময় ছেলেটা তার মেধার পরিচয় দিল। কাগজে মুড়ে এক প্যাকেট ‘বাদশাহ’ দিয়ে বলল, “আঙ্কেল এটা নিয়ে যান। ভালো ব্রেন্ডের জিনিস। আর এগুলা সবই ‘ওয়ান টাইম’ বুঝলেন।”
এনায়েত মোল্লা ভালো করে প্যাকেট দেখেননি। তিনি হাসিমুখে বললেন, “আমি এসব কখনো লাগাইনি। তুমি একটু কষ্ট করে আমার পায়ে লাগিয়ে দিতে পারবা?”
ছেলেটা তার কথা শুনে বড়সড় ধাক্কা খেল। অবাক হয়ে বলল, “পায়ে লাগাবেন?”
এনায়েত মোল্লা বিরক্ত হয়ে বললেন, “পায়ে দরকার হলে তো পায়েই লাগাতে হবে। হাতে লাগালে তো কাজ হবে না। দাও সুন্দর করে লাগিয়ে দাও।” ছেলেটা বলল, “কাকা আপনি আমার বাপের বয়সী। এসব কী বলেন।”
এনায়েত মোল্লা নিজেই প্যাকেট খুললেন। তিনি যখন দোকান ছেড়ে চলে এলেন ছেলেটা দুই হাতে গাল ধরে বসে আছে। এনায়েত মোল্লার চড় সম্পর্কে তার আগে থেকে কোন ধারণা ছিল না।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে এনায়েত মোল্লার মেজাজ অবনতির দিকে যেতে থাকল। পায়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দীর্ঘ সময় মুচির দোকানে সিরিয়াল দিয়ে তিনি জুতা সারিয়ে নিয়েছেন। এলাকায় মুচি বসে না বলে তাকে বড় রাস্তার মোড়ে আসতে হয়েছে। এখান থেকে কাছেই বাজার। বাজারের কাছেই যখন এসে পড়েছেন তাহলে এখান থেকেই চাপাতি কেনা যাবে।

মোটামুটি বড়সড় একটা দোকানে গিয়ে তিনি চাপাতি চাইলেন। এই দোকানে অনেক বেশি মালামাল। এক জায়গাতে বসেই যাতে সবকিছু সহজেই পাওয়া যায় সেজন্য দোকানী সব হাতের কাছেই রেখেছে। এনায়েত লক্ষ্য করলেন দোকানি পায়ের নিচ থেকে একটা বস্তা বের করল। সেটার ভেতর থেকে চাপাতি বের হলো। চাপাতির বস্তা এরা পায়ের নিচে রাখে না-কি! বিষয়টা তার রুচিতে বাধল। একজন চাপাতির উপর পা রেখে বসে আছে, সেই চা তিনি আরাম করে চুমুক দেবেন-ভাবতেই কেমন অস্বস্তি লাগে। তিনি পাশের দোকানে গেলেন। সেই দোকানে চাপাতার মেয়াদ শেষ। তার পাশের দোকানে ভালো চাপাতি নেই। এনায়েত মোল্লার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। এমন তো হওয়ার কথা না। তিনি ঠিক করলেন প্যকেটার চাপাতি কিনবেন না। আলগা চাপাতি কখনো কেনা হয়নি। একবার কিনে দেখা যেতে পারে।
তিনি অন্য গলিতে ঢুকলেন। খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন দেখে একটা দোকানে গিয়ে বললেন, “ভাই ভালো চাপাতি আছে?”
দোকানী হাসিমুখে বলল, “জ্বি আছে। কোন কোম্পানির টা লাগবো?”
“কোম্পানি সমস্যা না। ভালো হলেই হবে।”
“খোলাটা নিবেন না-কি প্যাকেট?”
“খোলাটা দেন।”
“দেশি কোম্পানির টা নিবেন না-কি বিদেশি?”
“দেশিটাই দেন।”
“সিলেট না-কি মৌলভীবাজার?”
এনায়েত মোল্লা বিরক্ত হয়ে বললেন, “ভাই একটা দেন তো। এত কথা জিজ্ঞেস করেন কেন?”
“আপনি যেটা চান সেটাই তো দিবো। নইলে তো বাসায় গিয়া ফেরত আনবেন। বলেন সিলেট না-কি মৌলভীবাজার?”
এনায়েত মোল্লা বিরক্তি নিয়ে বললেন, “সিলেট।”
“সিলেটের মিনা বাজার না-কি লক্ষী বাজার?”
এনায়েত মোল্লা রাগে কথা বলতে ভুলে গেলেন। তিনি কিছু একটা বলতে যাবেন-ঠিক এমন সময় পেছন থেকে একজন এসে তার কাধে হাত রাখল। লোকটা পান খাচ্ছিলো। সাদা লুঙ্গিতে পানের পিক মুছে নিয়ে সে হাসিমুখে বলল, “আপনে আমার লগে আসেন।” এনায়েত মোল্লাকে নিয়ে সে বাজারের বাইরে চলে এলো। নিরিবিলি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বলল, “চাচাজিকে অনেকক্ষণ ধইরা দেখতাছি চাপাত্তি দেখতাছেন। ভালো চাপাত্তি খুঁজতাছেন?”
এনায়েত মোল্লা বিরক্তি নিয়ে বললেন, “হুম।”
“ভালো পাত্তি কেনা কিন্তুক সহজ ঘটনা না।”
“আপনি কে?”
“আমি কে এইডা ঘটনা না। ঘটনা হইলো- এইহানে সব দুই নাম্বার জিনিস। আসল পাত্তি এরা পাইবো কই। আপনি পুরান ঢাকা চইল্যা যান। খাঁটি জিনিস পাইবেন।”
এনায়েত মোল্লা বললেন, “পুরান ঢাকায় ভালো চাপাতি পাওয়া যায়-এমন কথা তো শুনিনি।”
“আরে চাচাজি পুরান ঢাকার কোন জিনিসটা খাঁটি না। পুরান ঢাকার মাটিও মিষ্টি। কেউ খায় না তাই জানে না।”
এনায়েত মোল্লা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনি খেয়েছেন পুরান ঢাকার মাটি?”
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে লোকটা বলল, “আপনার ভালোর জন্য বলতেছি। এখন আপনার বিবেচনা। আবারও বলতেছি- আসল চাপাত্তি চেনা সহজ কাজ না।”

পুরান ঢাকায় এসে এনায়েত মোল্লা হতাশ হলেন। এলাকার বাজারের চায়ের সাথে এই চায়ের কোন পার্থক্য তার চোখে পড়ল না। প্যাকেটের চাপাতি দেখা বাদ দিয়ে তিনি আলগা চাপাতি দেখা শুরু করলেন। সেগুলোর গন্ধ শুকেই তার ভালো লাগলো না।
তিনি পুরো পুরান ঢাকা চষে ফেললেন। মনের মতো চাপাতি পেলেন না। লাভের মধ্যে যা হলো কেউ কেউ তাকে পাগল ভাবতে শুরু করল। সবাই অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। দুই একজন বলল, “ব্র‍্যান্ডের চাপাতি কেনেন ভাই। ব্র‍্যান্ডের চাপাতি খারাপ হইলেও নিজেরে বুঝ দিতে পারবেন। কিন্তু খোলা পাত্তি কিনলে আফসোস হইবো।”
তিনি হাল ছাড়লেন না। চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। একজন বলল, “চাচাজি এদিকে পাবেন না। আপনি আসল জিনিস চান? তাইলে কোন একটা ক্যান্টনমেন্টে ঢুইকা পড়েন। সেনাবাহিনীর জন্য যেই চাপাতি বরাদ্দ হয় ঐটা আসল জিনিস। একবার সেই চা খাইলে মনে হবে বেহেশতের চা খাচ্ছেন।”
বেহেশতের চা খাওয়ার লোভ তিনি সামলাতে পারলেন না। তিনি চললেন মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের দিকে। ততক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে। মূল এরিয়াতে ঢোকার আগেই দুজন সেনাসদস্য তাকে আটকে ফেলল। তিনি বললেন, “ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে না-কি ভালো চাপাতি পাওয়া যায়। এটা সত্য?”
সেনা সদস্য দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
তিনি আবার বললেন, “আসল জিনিস খুঁজতে আসছি। পাবো এখানে?”
একজন বলল, “আপনি চাপাতি নিতে আসছেন?”
এনায়েত মোল্লা কাচুমাচু করে বললেন, “আসলে ভালো চাপাতি খুঁজে পাচ্ছি না। সকাল থেকে ঘুরতেছি।”
একজন বলল, “চাচা, আপনার ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের কর্ণেল সাহেব খুবই কড়া লোক। আপনাকে ভেতরে নিতে পারছি না। আপনি যদি একদম ফ্রেশ চাপাতি পেতে চান সিলেট বা মৌলভীবাজার যেতে পারেন।”
এনায়েত মোল্লা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “সিলেট না-কি মৌলভীবাজার? কোন জায়গার চাপাতিটা বেশি ভালো হবে?”

এদিকে শায়লা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। এনায়েত মোল্লা ফোন বাসায় রেখেই বের হয়েছিলেন। শায়লা সব আত্মীয়ের বাসায় খোঁজ করল। তিনি কারো বাসায় যাননি। শায়লা নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলো। সে যদি লেবু চা না দিতো হয়তো মানুষটা আজ বাসায় থাকতো। দুই দিন চলে গেল এনায়েত মোল্লা বাসায় ফিরল না। বাসায় শোকের ছায়া নেমে এলো। তৃতীয় দিন থেকে বাসায় কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল।

পরিশিষ্ট- এনায়েত মোল্লা বাসায় ফিরলেন ২৩ দিন পর। সাথে নিয়ে ফিরলেন ট্রাক ভর্তি চাপাতি। বাসার সবাই যখন কান্নাকাটি করছে ঠিক ঐ মুহুর্তে ট্রাকের লোকজন চাপাতির বস্তা মাথায় করে রুমে ঢুকল। সবার কান্নাকাটি দেখে এনায়েত মোল্লা ভীষণ রাগারাগি শুরু করলেন। গলা উচিয়ে বললেন, “ভালো চাপাতি চাচ্ছিলে। নিয়ে এলাম। সুইজারল্যান্ড থেকে এনেছি। সুইজারল্যানন্ডের চাপাতি বিশ্বসেরা।”
শায়লা বিস্ময় নিয়ে বলল, “চাপাতি কেনার জন্য সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলে?”
“প্রথমে গেলাম ভুটান। সেখানেও আসল জিনিস পেলাম না। ভুটান থেকে চলে গেলাম সুইজারল্যান্ড।”
“তুমি কী বলছো এসব?”
“ঠিকই বলছি। বেশি কথা বলো না। যাও, এখন ভালো করে এক কাপ চা করে নিয়ে আসো।” এনায়েত মোল্লা আনন্দে মাথা দোলাতে লাগলেন।
শায়ল রান্না ঘরের দিকে ছুটে গেল। মুহুর্তেই ফিরে এসে ভীতু গলায় বলল, “এখন চা হবে না। চিনি শেষ।”
এনায়েত মোল্লা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। তাকে চিনির খোঁজে যেতে হবে। (সমাপ্ত)
~ Maruf Al-amin – মারুফ আল আমিন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top