কিছুক্ষণ – যে মুহূর্ত ভালোবাসার

“আমাকে জানালার পাশের সীটটা দেয়া যাবে?” আমি বই পড়ছিলাম। মাথা তুলে দেখলাম মেয়েটিকে। আমাকে আন্তরিক ভঙ্গিতে প্রশ্নটি করে এখনও জোর করে মুখে এক টুকরো হাসি ধরে রেখেছে । আমি বললাম, “ অবশ্যই দেয়া যাবে। সুন্দরী মেয়েদের জন্য জানালার পাশের সীট ছেড়ে দেয়ার নিয়ম আছে। “ তাই? তা এই নিয়ম বুঝি এখন বানালেন? ”

মেয়েটি লাগেজ টেনে নিয়ে জানালার পাশের সীটে বসে পড়লো। আমি বললাম, “ হ্যাঁ, সুন্দরী মেয়েদের জন্য নতুন নতুন নিয়ম বানানোরও নিয়ম আছে। ” এবারে মেয়েটি হেসে ফেলল। ট্রেনের ঝকঝক শব্দে সেই হাসির শব্দ মৃদু শোনালো। মেয়েটি লাজুক ভঙ্গিতে বলল, “ দেখুন নিয়ম বানান আর যাই করুন- ফোন নাম্বার, ফেইসবুক আইডি এইসব চাওয়ার চেষ্টা করবেন না। ” “না ওসবে আমার আগ্রহ নেই। তাছাড়া সুন্দরী মেয়েদের সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ঠও হতে নেই। তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়।”“কিন্তু আপনি তো আমার পাশের সীটেই বসে আছেন। দূরত্ব থাকছে কোথায়?” “পাশে বসে থাকলেও সহস্র মাইল ব্যবধান আছে ম্যাম।” আমি হেসে বললাম। আমাকে অবশ্য বেশিক্ষণ মেয়েটির পাশে বসতে হলো না। পরের স্টেশনে একটি লোক নেমে যাওয়াতে তার সীটে আমার বসার সুযোগ হলো।। এখন আমরা মুখোমুখি বসে আছি। দুইজনই জানালার পাশে। চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি বলল, “আচ্ছা আপনার এমনটা কেন মনে হলো যে সুন্দরী মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে হবে। এটাও কি আপনার বানানো কোনো নিয়ম?” আমি বললাম, “সুন্দরের খুব বেশি কাছে যেতে নেই। একবার কাছ থেকে সৌন্দর্য দেখে ফেললে দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে।” “তাই নাকি? এমন তো শুনিনি কখনও।” “তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার ঘটতে পারে। দূর থেকে যা সুন্দর দেখায় কাছে চলে গেলে সেই সৌন্দর্য অনেক সময় চোখে পড়ে না। দূর থেকে যা খুব বেশি আকর্ষণীয় কাছ থেকে দেখলে তাই খুব সাদামাটা” “আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি দূর থেকে সুন্দর। কাছ থেকে দেখতে পঁচা?” “আমি সেটা কখন বললাম!” “এই যে মিস্টার, আপনি বই পড়ছিলেন পড়ুন। আমার সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করছেন আপনি। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন। আগেই বলে দিচ্ছি ভুলেও আমার সাথে প্রেম করার চেষ্টা করবেন না। একদমই না।” “দেখুন আপনি ভুল পথে ভাবনা এগিয়ে নিচ্ছেন । আমার মোটেও এরকম ইচ্ছে নেই। তাছাড়া আমি কোনো সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়তে চাই না। যদি কখনও প্রেম করি অল্প সুন্দরী মেয়ে বেছে নেবো।” “ইন্টারেস্টিং তো! এরকম ইচ্ছের কারণ? ” “কারণ খুব সুন্দরী কারও প্রেমে একবার পড়ে গেলে আর উঠে দাঁড়াতে পারবো না। নিচে পড়েই থাকবো।” এই সামান্য কথায় মেয়েটি মনে হচ্ছে অনেক বেশি মজা পেল। শব্দ করে হাসছে । হাসিটা অন্য রকম। শিশুদের হাসির মতো নির্মল যা আশেপাশের সবকিছুতেই মুগ্ধতা ছড়ায়। সেই হাসি বড় বেশি সংক্রামক। আমাকেও হাসতে হলো। আমি মেনে নিতে বাধ্য হলাম মেয়েটির হাসি সুন্দর। মন ভালো করে দেয়ার মতো সুন্দর। যেই হাসি এক নাগারে বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন ব্যাপার। এরকম হাসি দেখলে শুধু যে বুকের বা’ পাশে চিনচিন ব্যথা করে তা না। সেই ব্যথা অনায়াসেই বুকের ডান পাশ অবধি চলে আসে।

ধীরে ধীরে গল্প বেশ ভালোই জমে উঠলো। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো সেই হাসি। মেয়েটি একটু পর পর হাসছে আর সেই হাসি মুহূর্তেই এলোমেলো করে দিচ্ছে আমাকে। যখনই মেয়েটা হাসছে আমি বৈঠা বিহীন মাঝির মতো ভারসাম্য হারাচ্ছি। কী নিয়ে কথা বলছিলাম মনে থাকছে না। ভাবনায় ছেদ পড়লে যা হয়। মেয়েটা বলল, “তা আপনি যাচ্ছেন কোথায়? ” “এখনও ঠিক করিনি। কোনো একটা স্টেশন পছন্দ হলে নেমে যাব। ” “আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন মনে হচ্ছে আপনি মস্ত বড় একজন কবি-সাহিত্যিক।” “মস্ত বড় কিনা জানি না। কিন্তু আমি লেখালেখি করি।” “তাই? আপনাকে তো চিনি না। নাম কী আপনার?” “হুমায়ূন আহমেদ।” “আজব তো! মিথ্যা বলছেন কেন?আপনার নাম হুমায়ূন আহমেদ হতে যাবে কেন? উনি কত বড় একজন লেখক।” “হ্যাঁ, উনি অনেক বড় একজন লেখক। তাই বলে কি আর কারও নাম হুমায়ূন হতে পারে না?” “আপনার নাম সত্যি হুমায়ূন আহমেদ?” “হ্যা। আমার সাথে ভোটার আইডি কার্ড আছে। আপনি চাইলে দেখাতে পারি।” “না না থাক। দেখাতে হবে না। আ’ম সরি।” “আমার মা হুমায়ূন স্যারের লেখা খুবই পছন্দ করেন। তাই আমার নামও উনার নামে রেখেছেন।” জবাবে মেয়েটা কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ দমকা বাতাস ছুটে এল। বসন্তের মাতাল করা বাতাস নয়। বর্ষার ভেজা বাতাস। মেয়েটার একপাশের চুল বাতাসে উড়ে মুখ ঢেকে ফেলেছে। অন্যরকম একটি অবয়ব। ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে চুল সরিয়ে দিতে। সেটি সম্ভব না। আমরা বলতে গেলে প্রায় ‘অসম্ভব’ একটা জগতে বাস করি। এক জীবনের বেশিরভাগ ইচ্ছাই আমরা ‘সম্ভব না’ বলে কাটিয়ে যাই। “বাতাসে কারো টিপ খুলে যায় দেখিনি। আপনার কপালের টিপ কিন্তু এক পাশে সরে গেছে।” মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম। মেয়েটা টিপ দেখার জন্য কপালে হাত দিয়েছে। পুরো কপাল হাতরে টিপ খুঁজে পাওয়া গেল না। এবারে জোরে হেসে ফেললাম আমি। মেয়েটা মিছেমিছি রাগের ভান করে বলল, “আপনি তো ভালই পাজি। আমি আজ টিপই পরিনি। কিন্তু এমন ভাবে বললেন বিশ্বাস করে ফেললাম।”

ভেজা বাতাসের পর এবার বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশে মিষ্টি রোদ ছিলো। হঠাৎ করে এমন ভাবে বৃষ্টি নেমে যাবে বোঝা যায়নি। প্রকৃতির এমন খেয়ালিপনা দেখে মনে হল- আমাদের গল্প করার সময়টাকে স্মরণীয় করে রাখতেই যেন প্রকৃতির এই আয়োজন। আমি মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছি। আজকের বৃষ্টিটা অন্যরকম। ভিজতে ইচ্ছে করছে। “চা খাবেন? ট্রেনে উঠলেই আমার চা খেতে ইচ্ছা করে। তাই ফ্লাস্ক ভর্তি চা ছাড়া ট্রেনে উঠি না পারতপক্ষে।” মেয়েটার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, “হ্যা খাব। চা আমি সাধারণত খাই না। তবে ওই যে নিয়ম আছে সুন্দরী কেউ চায়ের অফার করলে না করতে নেই।” “হয়েছে। আপনি যে লেখক আর বোঝাতে হবে না। ক চামচ চিনি খান আপনি?” “চিনি খাই না।” “একটু ও না?এভাবে ভালো লাগবে?” “এক কাজ করুন; চিনির বদলে আমার চায়ে দুই ফোটা বৃষ্টির জল দিয়ে দিন। আমার এতেই চলবে।” “সত্যি? দিবো?” “সত্যি।” মেয়েটি আমার কাপে বৃষ্টির জল দিয়ে দিল। সাথে নিজের কাপেও নিল। “আপনার দেখাদেখি আমিও খাচ্ছি রেইন টি। কী অদ্ভুত ব্যাপারটা!” আমি কিছু বললাম না। নিশ্চুপ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। মেয়েটাও কিছু সময় কথা বলল না। চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখে চোখ পড়তেই আমি বললাম, “কী হলো?” মেয়েটা দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, “আপনি কেমন মানুষ বলুনতো। আমি আপনার নাম জানলাম। অথচ আপনি একবারও আমার নাম জানতে চাইলেন না।” “ওহ হ্যা। আপনার নাম জানা হয়নি। কী নাম আপনার?” “তিয়াশা। সুন্দর না নামটা?” “হ্যা, অনেক সুন্দর।” “আচ্ছা লেখক সাহেব, আপনি কোথায় যাচ্ছেন বললেন না তো।” “ওই যে বললামতো কোনো একটা স্টেশন পছন্দ হলেই নেমে যাব।” “এটা কেমন কথা! মিথ্যা বলছেন আপনি।” “নাহ তিশা, আমি মিথ্যা বলছি না।” “এই যে মিস্টার আমার নাম তিশা না, তিয়াশা।” “সরি তিয়াশা।” “আচ্ছা আপনি হঠাৎ এমন চুপচাপ হয়ে গেলেন যে? কী হয়েছে?” “কই না তো। কথা বলছি তো। তাছাড়া সুন্দরী মেয়েদের সাথে খুব বেশি গল্প করতেও নেই।” “ইশ, আপনার এই বোরিং ডায়ালগ বাদ দিন প্লিজ। আচ্ছা আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?” “হঠাৎ এই প্রশ্ন?” “আছে কিনা বলুন।” “নাহ নেই।” “হুম, বুঝলাম। আপনি কিন্তু আমাকে আবার জিজ্ঞেস করবেন না যে আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা। আপনি জিজ্ঞেস করলেও আমি কিন্তু বলবো না।” মিটিমিটি হেসে বলল সে। “হাহাহা, আচ্ছা ঠিক আছে আমি জানতে চাচ্ছি না।” মেয়েটি হয়তো ভেবেছিল আমি জিজ্ঞেস করবো তার কোনো প্রেমিক আছে কিনা। আমি জিজ্ঞেস করছি না দেখে মনে হল কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেছে ।

ট্রেনের গতি কমে আসাতে আমি হঠাৎ ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েটা বলল, “কোথায় যাচ্ছেন?” আমি বললাম, “নেমে যাব। এই স্টেশনটা পছন্দ হয়েছে।” “বৃষ্টি হচ্ছে তো। ভিজে যাবেন। এখানে না নেমে অন্য কোনো স্টেশনে নামলে হয় না?” “জি না ম্যাম। হয় না।” মুচকি হেসে বললাম আমি। আর কোনো কথা না বলে উঠে চলে এলাম। মেয়েটা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ভাল থাকবেন, আবারও হয়তো দেখা হয়ে যাবে।’-এই জাতীয় কিছু হয়তো আশা করেছিল সে। মেয়েটাকে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখে আমি ট্রেন থেকে নেমে গেলাম। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। আমার আসলে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছিল অনেক আগে থেকেই। নামার সাথে সাথেই ভিজে গেলাম। বৃষ্টির ফোটা গুলো একটু একটু করে আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। প্রকৃতির আহবানে আমি নেমে গেলাম ট্রেন থেকে কিন্তু অদৃশ্য এক শক্তি যেনো আমার হাত ধরে টানছে ট্রেনে ফিরে যাওয়ার জন্য। কানের কাছে কে যেন ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বলছে মেয়েটার সাথে আরেক কাপ বৃষ্টির জল মেশানো চা খাওয়ার জন্য। সেই অদৃশ্য আকর্ষণ উপেক্ষা করেই আমাকে নামতে হলো। কোন দিকে যাব ঠিক করতে পারছি না। মেয়েটা জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই বয়সী মেয়েরা খুব বেশি জেদি হয়। মেয়েটা আমাকে পেছন থেকে ডাকবে না। নিজের আবেগের কাছে হেরে যাবে না কখনোই। মনে মনে হয়তো আমাকে খুঁজবে কিন্তু পাবে না। কারণ আমি পরিচয় দেইনি।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে সেই সাথে আদ্র বাতাস। চলে আসবো এমন সময় আমি অবাক হয়ে মেয়েটার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। বৃষ্টি হচ্ছে এজন্য মেয়েটা প্রায় চিৎকার করে বলল, “এই যে হুমায়ূন সাহেব। আপনি আমাকে আসল নামটা বলেননি। তাই না?” আমি ফিরে তাকালাম। এক টুকরো হাসি ছুড়ে দিলাম। সরি বলা টাইপ হাসি। কোনো জবাব দিলাম না। ফিরে যাওয়ার সাহস আমার নেই। জগতটা রহস্যময়। জগতের সব রহস্যের ব্যাখ্যা থাকে না। ব্যাখ্যা থাকা উচিতও না। মেয়েটা আমাকে নিয়ে একটু হলেও ভাববে। আমি নাহয় একটু খানি রহস্য হয়েই থাকলাম। সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেলে প্রকৃতির সৌন্দর্য নষ্ট হবে। সেই অধিকার আমার নেই। বৃষ্টির মধ্যে সামনে এগুচ্ছি। চোখে মুখে বৃষ্টির ঝাট এসে লাগছে। বুকের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে যেই অনুভূতির সাথে আমার পরিচয় নেই। এমন সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমার বিস্ময় সীমাকে অতিক্রম করে আমাকে দ্বিতীয় বারের মতো ডাকলো মেয়েটা। আমার সব হিসেব নিকেশ এলোমেলো হয়ে গেলো মুহুর্তেই। এবারে আমাকে মেয়েটার কাছে ফিরে যেতে হবে। কেন যেতে হবে? কারণ মেয়েরা দ্বিতীয় বার ডাকলে সাড়া দেয়ার নিয়ম আছে। (সমাপ্ত)

#কিছুক্ষণ

লেখক- মারুফ আল আমিন

1 thought on “কিছুক্ষণ – যে মুহূর্ত ভালোবাসার”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top